তাজ উদ্দীন
বেগম খালেদা জিয়া, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বহুল আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ নাম। তাঁর জীবন কোনো রূপকথার চেয়ে কম নয়। ৩৬ বছর বয়সে স্বামী জিয়াউর রহমানকে হারানোর পর দুই সন্তানকে নিয়ে সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়েছিলেন তিনি। জিয়াউর রহমান যখন মারা যান, তখন বেগম জিয়ার হাতে ছিল না কোনো অর্থ-সম্পদ, ছিল না কোনো ব্যাংক ব্যালেন্স। কেবল ছিল ভাঙা স্যুটকেস আর ভবিষ্যৎ নিয়ে একরাশ অনিশ্চয়তা।
স্বৈরশাসক এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়ার পরিবারের জন্য শহীদ মঈনুল রোডে একটি একতলা বাড়ি বরাদ্দ করেন। সেখানেই বেগম জিয়া তাঁর দুই সন্তানকে বড় করেছেন। রাজনীতিতে একেবারেই অনভিজ্ঞ একজন সাধারণ গৃহবধূ, যিনি কখনো রাজপথে নামেননি, তিনিই নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁর আপোষহীন নেতৃত্ব এরশাদের পতন নিশ্চিত করে এবং বেগম জিয়াকে ‘আপোষহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়।
তবে, বেগম জিয়ার রাজনৈতিক জীবনে উত্থান-পতনের গল্পও কম নয়। তিনি যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় অনেক ব্যর্থতাও ছিল। কিন্তু কবি ইমতিয়াজ মাহমুদের ভাষায়, ‘একাত্তরের পর যতজন রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছেন, তিনিই একমাত্র সরকার প্রধান যিনি স্বৈরাচার হিসেবে পরিচিত হননি।’
১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে শুরু করে গত ১৭ বছরে বেগম জিয়াকে নিয়ে অনেক অপপ্রচার চালানো হয়েছে। তাঁকে রাজনৈতিকভাবে হেয় করার জন্য বিভিন্ন নোংরা কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি, তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শেখ হাসিনাও ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে পিছপা হননি। দুই কোটি টাকা এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে স্থানান্তরের অভিযোগে দীর্ঘ দেড় বছর আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে বেগম জিয়াকে। বৃদ্ধ বয়সে দুই বছর কারাভোগও করতে হয়েছে তাঁকে। অথচ, সেই সময়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও ১৫টি মামলা ছিল।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা বেগম জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন চেষ্টা চালিয়েছে। এমনকি, তাঁকে ‘স্লো পয়জনিং’-এর মাধ্যমে হত্যার ষড়যন্ত্রও করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁর স্মৃতিবিজড়িত মঈনুল রোডের বাড়িটি ভেঙে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস করছেন এবং ৫ই আগস্ট পর্যন্ত কার্যত গৃহবন্দী ছিলেন।
তবে, বেগম জিয়া এখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক জীবন্ত কিংবদন্তী। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় যে সম্মান ও দেশের প্রতি যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তার প্রতিদান দেওয়ার জন্য সৃষ্টিকর্তা তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ৩৬ বছর বয়সে স্বামীহারা বেগম জিয়া নিজের চোখে তাঁর ছোট সন্তানকে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে দেখেছেন। দীর্ঘ সাত বছর পর তিনি তাঁর একমাত্র জীবিত ছেলের কাছে যাচ্ছেন। কারো কারো আশংকা হয়ত তিনি আর রাজনীতিতে ফিরে আসবেন না।
কিন্তু ইতিহাস বলে, বেগম জিয়া ফিরে আসবেন। তিনি যেমন সগৌরবে দেশ ছেড়ে যাচ্ছেন, তেমনই সগৌরবে তিনি দেশে ফিরে আসবেন। তিনি এখনও বাংলাদেশের রাজনীতির ঐক্যের প্রতীক। সৃষ্টিকর্তা যেন তাঁর হায়াত আরও বাড়িয়ে দেন। বেগম জিয়া শুধু একজন রাজনীতিবিদ নন, তিনি বাংলাদেশের মানুষের আশা-ভরসার প্রতীক। তাঁর সংগ্রামী জীবন এবং রাজনৈতিক ত্যাগ তাঁকে দেশের মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন করে দিয়েছে।