এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। বাড়তি এই শুল্কহার কার্যকর করার আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে সময় চান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর তিন মাস সময় দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এর মধ্যে দেশটির সঙ্গে দরকষাকষি করে মাত্র দুই শতাংশ শুল্ক কমানো গেছে। সর্বশেষ ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প, যা আগামী আগস্ট মাস থেকে কার্যকর হবে।
প্রশ্ন উঠেছে— তিন মাস সময় পাওয়ার পরও কেন আশানুরূপ ফল এলো না? এক্ষেত্রে ব্যর্থতার দায় হিসেবে প্রস্তুতির অভাব, যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া বুঝতে না পারা বিশেষ করে; চুক্তি বা বিনিয়োগ নিয়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে না পারা এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
এতোদিন বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার ছিল গড়ে ১৫ শতাংশ। এখন নতুন করে অতিরিক্ত শুল্ক হয়েছে ৩৫ শতাংশ। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া অন্যান্য পণ্যের পাশাপাশি তৈরি পোশাক রপ্তানি নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। যদি আগস্ট থেকে নতুন শুল্কহার কার্যকর হয়, তবে পোশাক রপ্তানি বড় ধাক্কা খাবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এখনো আলোচনা চলমান। যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত শুল্ক চূড়ান্ত নয়। ৯ জুলাই ভোরে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের (ইউএসটিআর) কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঢাকার বাণিজ্য প্রতিনিধিদের বৈঠক হবে। ওই বৈঠক থেকে ইতিবাচক কিছু আশা করছে সরকার।
ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পর গত ২ এপ্রিল শতাধিক দেশের ওপর চড়া হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের ওপর বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্কের ঘোষণা আসে। নতুন এ উদ্বেগের মধ্যে শুল্ক পুনর্বিবেচনা করতে ট্রাম্পকে চিঠি পাঠান প্রধান উপদেষ্টা। বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তুলে ধরে শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত তিন মাস স্থগিত রাখার অনুরোধ করা হয় সেখানে। এরপর তিন মাস সময় দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে এবং সংলাপের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে দেশটির ৬২৬টি পণ্যে শুল্ক ছাড়ের ঘোষণা দেওয়া হয় বাজেটে। এর মধ্যে ১১০টি পণ্যের আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়।
এদিকে গত ৭ জুলাই নতুন শুল্ক আরোপের কথা জানিয়ে ১৪টি দেশের নেতাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সেই তালিকায় বাংলাদেশও ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে অনেক বছর আলোচনা করেছি এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে বাংলাদেশের শুল্ক ও অশুল্ক, নীতিসমূহ এবং বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতার কারণে যে দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা থেকে আমাদের অবশ্যই সরে আসতে হবে। দুঃখজনকভাবে, আমাদের সম্পর্ক একে অপরের সমকক্ষ থেকে অনেক দূরে। ২০২৫ সালের ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো বাংলাদেশের যেকোনো ও সব ধরনের পণ্যের ওপর আমরা মাত্র ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করব। এই শুল্ক সব খাতভিত্তিক শুল্কের অতিরিক্ত হিসেবে প্রযোজ্য হবে।
“উচ্চ শুল্ক এড়ানোর উদ্দেশ্যে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে পণ্য পাঠানো হলে সেগুলোর ওপরও সেই উচ্চ শুল্ক আরোপ হবে। অনুগ্রহ করে এটা অনুধাবন করেন যে ৩৫ শতাংশ সংখ্যাটি আপনার দেশের সঙ্গে আমাদের যে বাণিজ্য ঘাটতি বৈষম্য রয়েছে, তা দূর করার জন্য যা প্রয়োজন তার থেকে অনেক কম।”
চিঠিতে আরও বলা হয়, যদি বাংলাদেশ বা আপনার দেশের বিভিন্ন কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য উৎপাদন বা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে কোনো শুল্ক আরোপ করা হবে না। বস্তুত আমরা সম্ভাব্য সবকিছু করব যাতে দ্রুত, পেশাদারিত্বের সঙ্গে ও নিয়মিতভাবে অনুমোদন পাওয়া যায়, অন্যভাবে বললে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।
চিঠিতে পাল্টা শুল্কের পদক্ষেপ না নিতে হুঁশিয়ারি দেন ট্রাম্প। এ প্রসঙ্গে চিঠিতে বলা হয়েছে, যদি কোনো কারণে আপনি আপনার শুল্ক বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন আপনি যে পরিমাণ শুল্ক বাড়াবেন, তা আমাদের আরোপিত ৩৫ শতাংশ শুল্কের ওপর যোগ করা হবে।
চিঠিতে হুঁশিয়ারির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়ার সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়ালে শুল্ক কমানোর ইঙ্গিত রয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, আপনার বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে আমরা আগামী বছরগুলোতে আপনার সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে চাই। আপনি যদি এখন পর্যন্ত বন্ধ রাখা আপনার বাণিজ্য বাজার যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উন্মুক্ত করতে চান এবং শুল্ক, অশুল্ক নীতি ও বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা দূর করেন, তাহলে আমরা সম্ভবত এই চিঠির কিছু অংশ পুনর্বিবেচনা করতে পারি। এই শুল্কহার আপনার দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে বাড়ানো বা কমানো হতে পারে।
বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর মঙ্গলবার অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত শুল্ক চূড়ান্ত নয়। ওয়ান টু ওয়ান নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে এটা ঠিক হবে।
একইদিন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, ৯ জুলাইয়ের আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে একটি ‘ট্যারিফ ডিল’ হওয়ার আশা করা হচ্ছে।
তিন মাস সময় পাওয়ার পরও কেন আশানুরূপ ফল এলো না, জানতে চাওয়া হয় অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবিবের কাছে। তিনি মনে করেন, অন্যান্যদের মতো আমাদের বাণিজ্যিক দরকষাকষিতে ভালো অভিজ্ঞতা নেই। আমরা কারো সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিও করিনি। মার্কিনিদের ভাষা-পরিভাষা আমাদের সেভাবে জানাও নেই। আসলে গত তিন মাসে আমরা বিষয়টি হ্যান্ডেল করতে পারিনি। যতটুকু সময় ছিল এই সময়ে ভারত, চীন ও ভিয়েতনাম সবকিছু মোটামুটি ঘুচিয়ে নিয়েছে, এরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতায় গেছে। কিন্তু আমরা সেটা পারিনি।
মাহফুজ কবির বলেন, আলোচনা করার জন্য আমাদের যে ব্যাপক প্রস্তুতি দরকার, সেটার অভাব ছিল। প্রস্তুতির জায়গায় আমরা অনেক সময় পার করে ফেলেছি। এখানে একটা খসড়া চুক্তি তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বসা দরকার ছিল, কিন্তু সেটাতে আমরা যাইনি। আমাদের হয়তো ধারণা ছিল, বিষয়টি এতো কঠিন হবে না। বাংলাদেশের প্রস্তাব আকর্ষণীয় মনে হয়নি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। এ কারণে হয়তো প্রধান উপদেষ্টাকে সম্মান দেখিয়ে ট্রাম্প দুই শতাংশ কমিয়েছেন। যদি এই সময়ের মধ্যে ভিয়েতনাম করতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারলাম না? চীনের সঙ্গে এত বিরোধ, তারপরও কিন্তু তারা একটা সমঝোতায় চলে গেছে, ভারতের সঙ্গে প্রায় চুক্তি হওয়ার পথে।
বুধবার ওয়াশিংটনে বাণিজ্য উপদেষ্টার বৈঠকের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি। তবে সময় বেশি নেই। এ বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সার্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে একটা আকর্ষণীয় প্যাকেজ দিতে হবে। যদি সম্ভব হয় একটা খসড়া চুক্তি নিয়ে বসতে হবে, যেমন- বাণিজ্য কত বাড়াবে, আমদানি কতটুকু বাড়াবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আরেকটি কাজ করতে হবে, বিনিয়োগের প্রস্তাব তুলে ধরতে হবে। আমাদের কিছু তৈরি পোশাকের কারখানা কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে স্থাপন করতে পারি। একই সঙ্গে ফার্মাসিউটিক্যাল, প্লাস্টিক ও ইলেকট্রনিক্স পণ্যের কারখানা স্থাপন করতে পারি। তবে এটা নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি নেই বলে আমার মনে হয়।
যুক্তরাষ্ট্র আসলে চায় আমরা দেশটিতে বিনিয়োগ করি। যুক্তরাষ্ট্র তো বলেছে, বিনিয়োগ করলে শুল্ক থাকবে না। এ ইস্যুতে আমাদের কোনো ভিন্ন কৌশল অবলম্বন না করে পরিষ্কারভাবে জানাতে হবে আমরা চুক্তি করতে আগ্রহী, যোগ করেন মাহফুজ কবির।
অপরদিকে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষি নিয়ে খুব একটা আশাবাদী নন তিনি। তার মতে, আলোচনা চলতে পারে, তবে বাংলাদেশকে এখন ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, ৩৫ শতাংশ সামাল দেব কীভাবে? এই চিন্তাও করা উচিত বাংলাদেশের। পোশাক খাতের জন্য নতুন বাজার খোঁজার পাশাপাশি বায়ারদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার পরামর্শ দেন তিনি।