ঢাকা ০২:৩১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব, বিনিয়োগে ভাটা

রাজস্ব ঘাটতির চাপে সরকার, বাড়ছে ঋণের বোঝা

  • অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০৭:৫৩:৪৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫
  • 15

পতনে জর্জরিত পুঁজিবাজার, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, এনবিআরের কর্মবিরতির মতো নানা প্রতিকূলতায় বিপর্যস্ত দেশের রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা। আয় কমে যাওয়ায় ও ব্যয় থেমে না থাকায় চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসেই ঘাটতির অঙ্ক ছাড়িয়েছে এক লাখ কোটি টাকা। এর ফলে মারাত্মক চাপে পড়েছে সরকারের কোষাগার।

অর্থবছরের শুরুতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জন্য ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরে তা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামানো হয়। কিন্তু তাও পূরণ করা সম্ভব হয়নি। ১১ মাসে আদায় হয়েছে মাত্র ৩ লাখ ২২ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১ লাখ ২ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা কম।

লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে জুন মাসে এনবিআরকে একক মাসে ১ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব আদায় করতে হবে, যা প্রায় অসম্ভব বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অন্যদিকে ব্যয় থেমে নেই। ফলে সরকারকে ধারনির্ভর হতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দেশীয় ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে ঘাটতি পূরণের চেষ্টা চলছে। তবে এভাবে চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি আরও সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকার দেশি-বিদেশি উৎস থেকে মোট ২৩ লাখ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় ১২ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা এবং দেশীয় উৎস থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ১০ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা।

ঋণ বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে সুদের দায়ও। উদাহরণস্বরূপ, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৬ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা ঋণ নিলেও একই সময়ে শুধু সুদ পরিশোধেই ব্যয় হয়েছে ৪৩ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজস্ব ঘাটতি মোকাবিলায় এখনই প্রয়োজন কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, “সরকারের সামনে এখন একমাত্র উপায় হচ্ছে ঋণ নেওয়া। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। আবার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণ সরবরাহ ব্যাহত হবে, যা বিনিয়োগ হ্রাস করবে।”

রাজস্ব ঘাটতির ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের ওপরও চাপ বাড়বে বলে মন্তব্য করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, “বর্তমান রাজস্ব ঘাটতি বাজেট কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনে দেবে। আয় না বাড়লে আমরা ঋণচক্রে পড়ে যাবো।”

রাজস্ব আয় বাড়াতে কী করণীয় তা নিয়ে এনবিআর চেয়ারে থাকা মো. আবদুর রহমান খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, “লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় ত্রুটি রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমদানি হ্রাস, উৎপাদন ব্যাঘাতসহ নানা কারণে রাজস্ব আদায়ে ব্যাঘাত ঘটছে।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজস্ব আদায়ের জন্য কর কাঠামো সংস্কার, করদাতা ডেটাবেইসের উন্নয়ন, কর ফাঁকি রোধ, এবং ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কর আদায়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। এসএমএসি অ্যাডভাইজারি সার্ভিসেস লিমিটেডের পরিচালক স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, “রিটার্ন না দেওয়া করদাতাদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি ভ্যাট ব্যবস্থায় ই-ইনভয়েসিং ও ক্যাশলেস লেনদেন চালু করতে হবে।”

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, রাজস্ব আদায়ে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না এলে ভবিষ্যতে সরকারের ব্যয় সংকোচন ছাড়া বিকল্প পথ থাকবে না। একইসঙ্গে, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফেরাতে না পারলে অভ্যন্তরীণ আয়ের দুর্বলতাও কাটবে না।

ট্যাগস :

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব, বিনিয়োগে ভাটা

রাজস্ব ঘাটতির চাপে সরকার, বাড়ছে ঋণের বোঝা

আপডেট সময় : ০৭:৫৩:৪৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫

পতনে জর্জরিত পুঁজিবাজার, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, এনবিআরের কর্মবিরতির মতো নানা প্রতিকূলতায় বিপর্যস্ত দেশের রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা। আয় কমে যাওয়ায় ও ব্যয় থেমে না থাকায় চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসেই ঘাটতির অঙ্ক ছাড়িয়েছে এক লাখ কোটি টাকা। এর ফলে মারাত্মক চাপে পড়েছে সরকারের কোষাগার।

অর্থবছরের শুরুতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জন্য ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরে তা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামানো হয়। কিন্তু তাও পূরণ করা সম্ভব হয়নি। ১১ মাসে আদায় হয়েছে মাত্র ৩ লাখ ২২ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১ লাখ ২ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা কম।

লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে জুন মাসে এনবিআরকে একক মাসে ১ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব আদায় করতে হবে, যা প্রায় অসম্ভব বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অন্যদিকে ব্যয় থেমে নেই। ফলে সরকারকে ধারনির্ভর হতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দেশীয় ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে ঘাটতি পূরণের চেষ্টা চলছে। তবে এভাবে চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি আরও সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকার দেশি-বিদেশি উৎস থেকে মোট ২৩ লাখ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় ১২ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা এবং দেশীয় উৎস থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ১০ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা।

ঋণ বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে সুদের দায়ও। উদাহরণস্বরূপ, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৬ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা ঋণ নিলেও একই সময়ে শুধু সুদ পরিশোধেই ব্যয় হয়েছে ৪৩ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজস্ব ঘাটতি মোকাবিলায় এখনই প্রয়োজন কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, “সরকারের সামনে এখন একমাত্র উপায় হচ্ছে ঋণ নেওয়া। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। আবার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণ সরবরাহ ব্যাহত হবে, যা বিনিয়োগ হ্রাস করবে।”

রাজস্ব ঘাটতির ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের ওপরও চাপ বাড়বে বলে মন্তব্য করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, “বর্তমান রাজস্ব ঘাটতি বাজেট কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনে দেবে। আয় না বাড়লে আমরা ঋণচক্রে পড়ে যাবো।”

রাজস্ব আয় বাড়াতে কী করণীয় তা নিয়ে এনবিআর চেয়ারে থাকা মো. আবদুর রহমান খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, “লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় ত্রুটি রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমদানি হ্রাস, উৎপাদন ব্যাঘাতসহ নানা কারণে রাজস্ব আদায়ে ব্যাঘাত ঘটছে।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজস্ব আদায়ের জন্য কর কাঠামো সংস্কার, করদাতা ডেটাবেইসের উন্নয়ন, কর ফাঁকি রোধ, এবং ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কর আদায়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। এসএমএসি অ্যাডভাইজারি সার্ভিসেস লিমিটেডের পরিচালক স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, “রিটার্ন না দেওয়া করদাতাদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি ভ্যাট ব্যবস্থায় ই-ইনভয়েসিং ও ক্যাশলেস লেনদেন চালু করতে হবে।”

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, রাজস্ব আদায়ে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না এলে ভবিষ্যতে সরকারের ব্যয় সংকোচন ছাড়া বিকল্প পথ থাকবে না। একইসঙ্গে, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফেরাতে না পারলে অভ্যন্তরীণ আয়ের দুর্বলতাও কাটবে না।