ঢাকা ১০:৩০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

লন্ডনের সাংবাদিক ফয়সল চৌধুরী কি এখনো ভয়ানক সাইবার দুর্বৃত্ত কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহী?

  • প্রতিনিধি
  • আপডেট সময় : ০২:৩২:৩৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ অগাস্ট ২০২৪
  • 210

 

দুলাল আহমদ চৌধুরী :
‘দেশবিরোধী ভয়ানক তিন সাইবার দুর্বৃত্ত’ শিরোণামে একটি খবর বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনলাইনে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখা ছিলো। ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর খবরটি প্রথম প্রকাশ করা হয়। খবরটির হেডলাইন হঠাৎ কেউ দেখলে মনে হবে, এরা বাংলাদেশবিরোধী এবং ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধী। আর সংবাদপত্রের চরিত্র সম্পর্কে যাদের ন্যূনতম ধারণা আছে, তারা রিপোর্টটির গঠনশৈলি দেখলে বুঝতে অসুবিধা হবে না যে, এই তিনজন হয়তো পত্রিকার মালিক কিংবা সম্পাদকের পাকা ধানে মই দিয়েছে অথবা সরকারের কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের হীনকর্ম চরিতার্থ করতে এরা প্রধান বাধা ছিলেন। এমন জগণ্য ভাষায় তিনজন প্রবাসী বাংলাদেশিকে আক্রমন করে বাংলাদেশ প্রতিদিন কৃর্তৃপক্ষ সরকারের কাছ থেকে কি ফায়দা হাসিল করেছে, তা পত্রিকাটির মালিক পক্ষ বসুন্ধরা গ্রুপ গত ১৬ বছরে ‘মোটা-তাজা’ হওয়া থেকে সহজেই অনুমেয়।
রিপোর্টে এই তিনজনকে দেশবিরোধী দিগভ্রান্ত সাংবাদিক, কথিত বুদ্ধিজীবী, মস্তিস্ক বিকৃত এবং পাগল শ্রেণীর বলে আখ্যায়িত করে বলা হয়, এরা বিদেশে বসে মিথ্যাচার, উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত এবং দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কোনো ধারণের গ্রহণযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই বলা হয়. এই ৩ জন যুদ্ধাপরাধী অপশক্তি এবং জঙ্গিবাদের পক্ষে জনসর্থন আদায় করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। এদের কেউ কেউ আইএস এবং হিযবুত তাহরীরের সঙ্গেও সম্পৃক্ত বলে তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। জামায়াতে ইসলামী ও পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার পেইড এজেন্ট বলেও এদের কাউকে কাউকে সন্দেহ করা হচ্ছে। কারো সম্পর্কে না জেনে এমন উদ্ভট ও কাল্পনিক হলুদ সাংবাদিকতা চালিয়ে দিয়েছে গোয়েন্দা সুত্র বলে।
কাল্পনিক এই রিপোর্টে বলা হয়, ‘সরকার, প্রধানমন্ত্রী, শিল্পপতি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার ও গুজব ছড়ানোই কথিত সাংবাদিক ফয়সল চৌধুরী সুয়েবের মূল কাজ। তিনি মিথ্যাচার করে চলেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ, এস আলম গ্রুপ, এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিস শরাফতসহ বিভিন্নজনের বিরুদ্ধে ইচ্ছামাফিক বিষোদ্গার করে যাচ্ছেন এই স্বঘোষিত পন্ডিত’। একই রিপোর্ট বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন আরেকটি দৈনিক পত্রিকা কালেরকণ্ঠেও হুবহু প্রকাশ হয়।
আমার এই লেখা উপরুক্ত ‘তিন সাইবার দুর্বৃত্ত’র সাফাই নয়। এখানে প্রথম একজন হচ্ছেন পুরো যুক্তরাজ্য তথা ইউরোপের বাংলা মিডিয়া এবং বাংলাদেশি কমিউনিটিতে অত্যন্ত সুপরিচিত সাংবাদিক, আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী সুয়েব। অপর দুজন পিনাকী ভট্টাচার্য এবং তাজ হাসমী সম্পর্কে আমার উল্লেখযোগ্য কোনো ধারণা নেই। তবে শুনেছি, তারা ইউটিউবে আওয়ামী লীগ সরকার তথা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কড়া সমালোচক। তাদের সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাইনা । তবে যে ভাষায় একটি দায়িত্বশীল সংবাদপত্র তাদেরকে আক্রমন করেছে, তাতে স্বার্থান্বেষী মহলের ব্যক্তিগত গাত্রদাহ রয়েছে বলেই মনে করতেই পারি। আমার আজকের লেখা মুলতঃ রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী সুয়েবকে নিয়ে।
ফয়সল চৌধুরীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বকাল প্রায় ২৫ বছর। একজন প্রগতিশীল, রুচিবান, সৎ এবং দেশাত্ববোধসম্পন্ন অসীম সাহসী একজন সাংবাদিক। চ্যানেল আই-এর ইউকে এন্ড ইউরোপের মালিক ছিলেন । আশির দশকে সিলেট থেকে তার সাংবাদিকা শুরু। লন্ডনে তার ‘ ষ্ট্রেইট ডায়লগ’ অনুষ্ঠান ছিলো অত্যন্ত জনপ্রিয়। দেশ থেকে লন্ডনে সফরকারী সরকার ও বিরোধীদলসহ নানা পেশার রতি মহারতিরা ষ্ট্রেইট ডায়লগে অংশ নিতে অনেককে তদবির করতেন। এই অনুষ্ঠানে ফয়সল চৌধুরীকে কখনো তৈলবাজি, করমর্দন কিংবা চাটুকারিতা করতে দেখেনি কেউ । দেশের স্বার্থে যা বিশ্বাস করতেন, অবলিলায় তা বলে যেতেন অত্যন্ত জোরালো ভাবে। সর্বশেষ ভোটরবিহীন ৩টি নির্বাচন নিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচনায় তিনি অত্যন্ত স্পষ্টবাদী ও জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। অবশ্য তার ‘মুখকাটা’ স্বভাবের কারণে লন্ডনের অনেক প্রভাবশালী বাংলাদেশি রাজনীতিক তাকে এড়িয়ে চলতেন।
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার পাটলী গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের জন্ম ও বেড়ে উঠা ফয়সল চৌধুরী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার আরেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা ডা. আনোয়ারা আলীর সঙ্গে। ইংল্যান্ডে বেড়ে ওঠা এবং ব্রিটিশ সরকারে দেওয়া এমবিই খেতাবধারী ডা. আনোয়ারা আলী লন্ডনের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে অত্যন্ত সুপরিচিত এবং জনপ্রিয় চিকিৎসক। ছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটস এর কাউন্সিলর। কনজারভেটিভ পার্টির প্রভাবশালী নেত্রী হিসাবেও শীর্ষমহলে তার ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডা. আনোয়ারা আলী ব্রিটিশ সরকারের ওভজারভার হিসাবে বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আসেন।
ফয়সল চৌধুরীর ‘ভয়ানক দুর্বৃত্ত’ হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে অপ্রকাশিত অনেক ঘটনা। আমি যতদুর জানি, লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ডিফেন্স উপদেষ্টা হিসাবে পোস্টিং পাওয়া একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তার স্টেইট ডায়লগের টুটি চেপে ধরতে চেয়েছিলেন। সে অনেক লম্বা ইতিহাস যা অল্প লেখায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে, সরকার সংশ্লিষ্টতায় দানব হয়ে উঠা এই জেনারেল সরকারের সমালোচনা বন্ধ করাতে না পেরে তাকে বাংলাদেশে ধরে নিয়ে যাওয়ার হুমকিও দিয়েছিলেন। তৎকালীন সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বকে দিয়ে ঢাকার চ‍্যানেল আইর মালিক ফরিদুর রেজা সাগর ও শাইখ সিরাজকে দিয়ে ইউকে এন্ড ইউরোপে চ্যানেল আই বন্ধ করে দিয়েছিলেন অন‍্যায়ভাবে, তার ও এক লম্বা ইতিহাস রয়েছে। প্রায় বারো কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে লন্ডনে চ্যানেল আই বন্ধ হওয়ার কারনে। শেষমেষ তাকে বলছিলেন, দেশে গেলে শায়েস্তা করবেন। ফয়সল চৌধুরীর অবশ্য শেষ ৮ বছর আর আর দেশে যাওয়া হয়নি। আমার মনে হয়, তার অপেক্ষার ইতি হয়েছে। চলতি সপ্তাহে সেই দানব মেজর জেনারেলের (যিনি ছিলেন একজন সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি ও উপমন্ত্রীর ভাই) পদচ্যুতি হয়েছে।
আরেকটি ঘটনা হচ্ছে, বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি ও বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের মুসল্লি কমিটির প্রধান উপদেষ্টা সায়েম সোবহান আনভীরের ‘ভয়ঙ্কর নারী কেলেঙ্কারী’। আনভীরের বান্ধবী মোসারাত জাহান মুনিয়াকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় পিবিআই আনভীরকে দায়মুক্তি দিয়ে ফাইনাল রিপোর্ট প্রদান করে। দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করা এই ঘটনায় বাংলাদেশে একমাত্র দৈনিক মানবকণ্ঠ ধারাবাহিক রিপোর্ট প্রকাশ করে। সে সময় অবশ্য অন্যান্য সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে বসুন্ধরার বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনে সয়লাব হয়ে যায়। মুখে কুলুপ দেন সিনিয়র সাংবাদিকরা। দেশের চরম দুর্নীতিবাজ শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তারা ছিলেন বসুন্ধরার এমডির পদলেহনকারী। ভুমিদস্যু বসুন্ধরার এমডিকে নারী হত্যা থেকে দায়মুক্ত করতে সরকারের একধিক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ঘুম হারাম হয়ে যায়। সম্প্রতি খেয়াঘাটে ধরাপড়া এক প্রভাবশালী মন্ত্রী রিতিমতো বসুন্ধরার উপদেষ্টার ভূমিকায় নেমে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং সায়েম সোবহান আনভীরকে বিদেশ সফরসঙ্গি করেন। এমন প্রেক্ষাপটে মুনিয়া হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারে সোচ্চার ছিলেন ফয়সল চৌধুরী। তখনই তাকে নানা প্রলোভন দেয়া হয়, ব্যর্থ হয়ে নানা তকমা লাগিয়ে উদ্ভট ভিত্তিহীন রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এই রিপোর্টে শুধু ফয়সল চৌধুরীকেই হেয় করা হয়নি, একটি বহুল প্রকাশিত পত্রিকার ভাবমূর্তিও বিনস্ট করা হয়েছে। রয়েছে আরো বহু ঘটনা-রটনা। যা পরবর্তীতে তুলে ধরবো আশা রাখি।
ফয়সল চৌধুরী সুয়েব অবশ্য দাবি করলেন তার ‘বন্ধু সম্পাদক’ সরকারের তৈলবাজি করে দেশে-বিদেশে বিত্ত বৈভবে টুইটুম্বুর। লিঙ্গ কোটায় স্ত্রীকে করেছেন এমপি। এখন আম-ছালা নিয়ে চলছে টানাটানি। তিনি বললেন, এমন মিথ্যা-কাল্পনিক তথ্য উপস্থাপন করে আমার চরিত্র হননের যে চেষ্টা ‘বন্ধু সম্পাদক’ করেছেন তাতে আমি মোটেও মনক্ষুন্ন হইনি। তবে একটু কস্ট পেয়েছি। এমনিতেই বন্ধুর ‘বনে পিঠ’ ঘুরছে না, বিপদের সময় আগুনে ঘি ঢালার স্বভাব আমার নেই। পারিবারিকভাবে শিখেছি- ক্ষমাই মহত্ত্বের লক্ষণ। কিন্তু এই জগন‍্য অপরাধের ক্ষমা করা ঠিক হবেনা।
বাংলাদেশে মহাবিপ্লব ঘটেছে। ব্যর্থ রাজনীতিক দল ও নেতাদের মুখে চুনকালি দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পুরো সরকারকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ ফয়সল চৌধুরী যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলেন তখন তার ছেলে জামি চৌধুরীর বয়স ৫ বা ৬ বছর। জামি এখন বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ডের শিক্ষার্থী। রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী হয়তো এবার প্রিয় জন্মভূমি, মা-মাটিকে দেখতে প্রিয় বাংলাদেশে যাবেন, নির্ভয়ে যাবেন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

ট্যাগস :

লন্ডনের সাংবাদিক ফয়সল চৌধুরী কি এখনো ভয়ানক সাইবার দুর্বৃত্ত কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহী?

আপডেট সময় : ০২:৩২:৩৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ অগাস্ট ২০২৪

 

দুলাল আহমদ চৌধুরী :
‘দেশবিরোধী ভয়ানক তিন সাইবার দুর্বৃত্ত’ শিরোণামে একটি খবর বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনলাইনে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখা ছিলো। ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর খবরটি প্রথম প্রকাশ করা হয়। খবরটির হেডলাইন হঠাৎ কেউ দেখলে মনে হবে, এরা বাংলাদেশবিরোধী এবং ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধী। আর সংবাদপত্রের চরিত্র সম্পর্কে যাদের ন্যূনতম ধারণা আছে, তারা রিপোর্টটির গঠনশৈলি দেখলে বুঝতে অসুবিধা হবে না যে, এই তিনজন হয়তো পত্রিকার মালিক কিংবা সম্পাদকের পাকা ধানে মই দিয়েছে অথবা সরকারের কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের হীনকর্ম চরিতার্থ করতে এরা প্রধান বাধা ছিলেন। এমন জগণ্য ভাষায় তিনজন প্রবাসী বাংলাদেশিকে আক্রমন করে বাংলাদেশ প্রতিদিন কৃর্তৃপক্ষ সরকারের কাছ থেকে কি ফায়দা হাসিল করেছে, তা পত্রিকাটির মালিক পক্ষ বসুন্ধরা গ্রুপ গত ১৬ বছরে ‘মোটা-তাজা’ হওয়া থেকে সহজেই অনুমেয়।
রিপোর্টে এই তিনজনকে দেশবিরোধী দিগভ্রান্ত সাংবাদিক, কথিত বুদ্ধিজীবী, মস্তিস্ক বিকৃত এবং পাগল শ্রেণীর বলে আখ্যায়িত করে বলা হয়, এরা বিদেশে বসে মিথ্যাচার, উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত এবং দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কোনো ধারণের গ্রহণযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই বলা হয়. এই ৩ জন যুদ্ধাপরাধী অপশক্তি এবং জঙ্গিবাদের পক্ষে জনসর্থন আদায় করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। এদের কেউ কেউ আইএস এবং হিযবুত তাহরীরের সঙ্গেও সম্পৃক্ত বলে তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। জামায়াতে ইসলামী ও পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার পেইড এজেন্ট বলেও এদের কাউকে কাউকে সন্দেহ করা হচ্ছে। কারো সম্পর্কে না জেনে এমন উদ্ভট ও কাল্পনিক হলুদ সাংবাদিকতা চালিয়ে দিয়েছে গোয়েন্দা সুত্র বলে।
কাল্পনিক এই রিপোর্টে বলা হয়, ‘সরকার, প্রধানমন্ত্রী, শিল্পপতি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার ও গুজব ছড়ানোই কথিত সাংবাদিক ফয়সল চৌধুরী সুয়েবের মূল কাজ। তিনি মিথ্যাচার করে চলেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ, এস আলম গ্রুপ, এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিস শরাফতসহ বিভিন্নজনের বিরুদ্ধে ইচ্ছামাফিক বিষোদ্গার করে যাচ্ছেন এই স্বঘোষিত পন্ডিত’। একই রিপোর্ট বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন আরেকটি দৈনিক পত্রিকা কালেরকণ্ঠেও হুবহু প্রকাশ হয়।
আমার এই লেখা উপরুক্ত ‘তিন সাইবার দুর্বৃত্ত’র সাফাই নয়। এখানে প্রথম একজন হচ্ছেন পুরো যুক্তরাজ্য তথা ইউরোপের বাংলা মিডিয়া এবং বাংলাদেশি কমিউনিটিতে অত্যন্ত সুপরিচিত সাংবাদিক, আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী সুয়েব। অপর দুজন পিনাকী ভট্টাচার্য এবং তাজ হাসমী সম্পর্কে আমার উল্লেখযোগ্য কোনো ধারণা নেই। তবে শুনেছি, তারা ইউটিউবে আওয়ামী লীগ সরকার তথা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কড়া সমালোচক। তাদের সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাইনা । তবে যে ভাষায় একটি দায়িত্বশীল সংবাদপত্র তাদেরকে আক্রমন করেছে, তাতে স্বার্থান্বেষী মহলের ব্যক্তিগত গাত্রদাহ রয়েছে বলেই মনে করতেই পারি। আমার আজকের লেখা মুলতঃ রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী সুয়েবকে নিয়ে।
ফয়সল চৌধুরীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বকাল প্রায় ২৫ বছর। একজন প্রগতিশীল, রুচিবান, সৎ এবং দেশাত্ববোধসম্পন্ন অসীম সাহসী একজন সাংবাদিক। চ্যানেল আই-এর ইউকে এন্ড ইউরোপের মালিক ছিলেন । আশির দশকে সিলেট থেকে তার সাংবাদিকা শুরু। লন্ডনে তার ‘ ষ্ট্রেইট ডায়লগ’ অনুষ্ঠান ছিলো অত্যন্ত জনপ্রিয়। দেশ থেকে লন্ডনে সফরকারী সরকার ও বিরোধীদলসহ নানা পেশার রতি মহারতিরা ষ্ট্রেইট ডায়লগে অংশ নিতে অনেককে তদবির করতেন। এই অনুষ্ঠানে ফয়সল চৌধুরীকে কখনো তৈলবাজি, করমর্দন কিংবা চাটুকারিতা করতে দেখেনি কেউ । দেশের স্বার্থে যা বিশ্বাস করতেন, অবলিলায় তা বলে যেতেন অত্যন্ত জোরালো ভাবে। সর্বশেষ ভোটরবিহীন ৩টি নির্বাচন নিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচনায় তিনি অত্যন্ত স্পষ্টবাদী ও জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। অবশ্য তার ‘মুখকাটা’ স্বভাবের কারণে লন্ডনের অনেক প্রভাবশালী বাংলাদেশি রাজনীতিক তাকে এড়িয়ে চলতেন।
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার পাটলী গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের জন্ম ও বেড়ে উঠা ফয়সল চৌধুরী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার আরেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা ডা. আনোয়ারা আলীর সঙ্গে। ইংল্যান্ডে বেড়ে ওঠা এবং ব্রিটিশ সরকারে দেওয়া এমবিই খেতাবধারী ডা. আনোয়ারা আলী লন্ডনের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে অত্যন্ত সুপরিচিত এবং জনপ্রিয় চিকিৎসক। ছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটস এর কাউন্সিলর। কনজারভেটিভ পার্টির প্রভাবশালী নেত্রী হিসাবেও শীর্ষমহলে তার ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডা. আনোয়ারা আলী ব্রিটিশ সরকারের ওভজারভার হিসাবে বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আসেন।
ফয়সল চৌধুরীর ‘ভয়ানক দুর্বৃত্ত’ হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে অপ্রকাশিত অনেক ঘটনা। আমি যতদুর জানি, লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ডিফেন্স উপদেষ্টা হিসাবে পোস্টিং পাওয়া একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তার স্টেইট ডায়লগের টুটি চেপে ধরতে চেয়েছিলেন। সে অনেক লম্বা ইতিহাস যা অল্প লেখায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে, সরকার সংশ্লিষ্টতায় দানব হয়ে উঠা এই জেনারেল সরকারের সমালোচনা বন্ধ করাতে না পেরে তাকে বাংলাদেশে ধরে নিয়ে যাওয়ার হুমকিও দিয়েছিলেন। তৎকালীন সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বকে দিয়ে ঢাকার চ‍্যানেল আইর মালিক ফরিদুর রেজা সাগর ও শাইখ সিরাজকে দিয়ে ইউকে এন্ড ইউরোপে চ্যানেল আই বন্ধ করে দিয়েছিলেন অন‍্যায়ভাবে, তার ও এক লম্বা ইতিহাস রয়েছে। প্রায় বারো কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে লন্ডনে চ্যানেল আই বন্ধ হওয়ার কারনে। শেষমেষ তাকে বলছিলেন, দেশে গেলে শায়েস্তা করবেন। ফয়সল চৌধুরীর অবশ্য শেষ ৮ বছর আর আর দেশে যাওয়া হয়নি। আমার মনে হয়, তার অপেক্ষার ইতি হয়েছে। চলতি সপ্তাহে সেই দানব মেজর জেনারেলের (যিনি ছিলেন একজন সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি ও উপমন্ত্রীর ভাই) পদচ্যুতি হয়েছে।
আরেকটি ঘটনা হচ্ছে, বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি ও বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের মুসল্লি কমিটির প্রধান উপদেষ্টা সায়েম সোবহান আনভীরের ‘ভয়ঙ্কর নারী কেলেঙ্কারী’। আনভীরের বান্ধবী মোসারাত জাহান মুনিয়াকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় পিবিআই আনভীরকে দায়মুক্তি দিয়ে ফাইনাল রিপোর্ট প্রদান করে। দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করা এই ঘটনায় বাংলাদেশে একমাত্র দৈনিক মানবকণ্ঠ ধারাবাহিক রিপোর্ট প্রকাশ করে। সে সময় অবশ্য অন্যান্য সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে বসুন্ধরার বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনে সয়লাব হয়ে যায়। মুখে কুলুপ দেন সিনিয়র সাংবাদিকরা। দেশের চরম দুর্নীতিবাজ শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তারা ছিলেন বসুন্ধরার এমডির পদলেহনকারী। ভুমিদস্যু বসুন্ধরার এমডিকে নারী হত্যা থেকে দায়মুক্ত করতে সরকারের একধিক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ঘুম হারাম হয়ে যায়। সম্প্রতি খেয়াঘাটে ধরাপড়া এক প্রভাবশালী মন্ত্রী রিতিমতো বসুন্ধরার উপদেষ্টার ভূমিকায় নেমে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং সায়েম সোবহান আনভীরকে বিদেশ সফরসঙ্গি করেন। এমন প্রেক্ষাপটে মুনিয়া হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারে সোচ্চার ছিলেন ফয়সল চৌধুরী। তখনই তাকে নানা প্রলোভন দেয়া হয়, ব্যর্থ হয়ে নানা তকমা লাগিয়ে উদ্ভট ভিত্তিহীন রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এই রিপোর্টে শুধু ফয়সল চৌধুরীকেই হেয় করা হয়নি, একটি বহুল প্রকাশিত পত্রিকার ভাবমূর্তিও বিনস্ট করা হয়েছে। রয়েছে আরো বহু ঘটনা-রটনা। যা পরবর্তীতে তুলে ধরবো আশা রাখি।
ফয়সল চৌধুরী সুয়েব অবশ্য দাবি করলেন তার ‘বন্ধু সম্পাদক’ সরকারের তৈলবাজি করে দেশে-বিদেশে বিত্ত বৈভবে টুইটুম্বুর। লিঙ্গ কোটায় স্ত্রীকে করেছেন এমপি। এখন আম-ছালা নিয়ে চলছে টানাটানি। তিনি বললেন, এমন মিথ্যা-কাল্পনিক তথ্য উপস্থাপন করে আমার চরিত্র হননের যে চেষ্টা ‘বন্ধু সম্পাদক’ করেছেন তাতে আমি মোটেও মনক্ষুন্ন হইনি। তবে একটু কস্ট পেয়েছি। এমনিতেই বন্ধুর ‘বনে পিঠ’ ঘুরছে না, বিপদের সময় আগুনে ঘি ঢালার স্বভাব আমার নেই। পারিবারিকভাবে শিখেছি- ক্ষমাই মহত্ত্বের লক্ষণ। কিন্তু এই জগন‍্য অপরাধের ক্ষমা করা ঠিক হবেনা।
বাংলাদেশে মহাবিপ্লব ঘটেছে। ব্যর্থ রাজনীতিক দল ও নেতাদের মুখে চুনকালি দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পুরো সরকারকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ ফয়সল চৌধুরী যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলেন তখন তার ছেলে জামি চৌধুরীর বয়স ৫ বা ৬ বছর। জামি এখন বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ডের শিক্ষার্থী। রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী হয়তো এবার প্রিয় জন্মভূমি, মা-মাটিকে দেখতে প্রিয় বাংলাদেশে যাবেন, নির্ভয়ে যাবেন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক