ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বছরে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) বাংলাদেশিদের টাকার পাহাড় জমেছে। ২০২৪ সালে এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ ফ্র্যাংক। স্থানীয় মুদ্রায় যা ৮ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা (প্রতি সুইস ফ্র্যাংক ১৫০ টাকা হিসাবে)। এই টাকা অন্তত ২২টি বেসরকারি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের সমান। আগের বছরের চেয়ে এই আমানত ৩৩ গুণ বেশি। ২০২৩ সালে যা ছিল ২৬৫ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। যেখানে এই সময়ে সুইস ব্যাংকে সারা বিশ্বের আমানত কমেছে।
বৃহস্পতিবার সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে কারা এই টাকা সুইস ব্যাংকে জমা রেখেছে সে তথ্য এই প্রতিবেদনে নেই। যদিও সুইস ব্যাংক তার কোনো আমানতকারীর তথ্য কখনো প্রকাশ করে না।
জানতে চাইলে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বৃহস্পতিবার বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ১৫ বছরে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। চামচা পুঁজিবাদ কীভাবে অলিগার্কদের জন্ম দিয়েছে, তার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘কীভাবে অলিগার্করা নীতি প্রণয়নকে নিয়ন্ত্রণ করেছে তাও আছে রিপোর্টে। এই প্রক্রিয়ায় দেশের ৮৫ শতাংশ সম্পদ ১০ শতাংশ মানুষ ভোগ করছেন। চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল পুরো অর্থনৈতিক কাঠামো। ওই সময়ে দেশের সম্পদশালীরা এ দেশকে নিরাপদ মনে করেনি। যে কারণে তারা বিদেশে সম্পদ পাচার করে সাম্রাজ্য গড়েছেন।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার যখন বিদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার জন্য নানামুখী প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে তখন সুইস ব্যাংকের এমন তথ্য খুবই উদ্বেগের। তারা মনে করেন, সুশাসনের অভাব এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকে উৎসাহিত করায় টাকা পাচারের লাগাম টানা সম্ভব হয়নি।
সাধারণত জাতীয় নির্বাচনের আগে নানা রকম শঙ্কা বিরাজ করে। এ কারণে দেশের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি ছাড়াও সমাজের বড় মাপের কালোটাকার মালিকরা ওই সময় সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচারের চিন্তা করে। ২০২৪ সালের শুরুতে ছিল জাতীয় নির্বাচন এবং একই বছর ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। এ দুটি প্রেক্ষাপটে দেশ থেকে টাকা পাচারের প্রবণতা বেড়ে যায়। যে কারণে অন্যান্য বছরের তুলনায় ২০২৪ সালে সুইস ব্যাংকে আগের বছরের তুলনায় টাকা জমা রাখার পরিমাণ ৩৪ গুণ বেড়ে যায়। তারা মনে করেন, দেশ থেকে বিভিন্ন উপায়ে দীর্ঘদিন থেকে টাকা পাচার হয়ে আসছে। এরমধ্যে ঋণের নামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা, বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ এবং ঘুস দুর্নীতির টাকাও দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশে পাঠানো হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শুধু সুইস ব্যাংক নয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টেও বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের তথ্য আসছে। বিষয়টি গভীর উদ্বেগজনক। কারণ সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের যে টাকা রাখা হয়েছে, সেটা মূলত দুর্নীতির। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের মূলত তিনটি কারণ। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে দুর্নীতি। কেননা দুর্নীতি বেড়েছে বলেই অর্থ পাচারও বেড়েছে। এছাড়া দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অর্থ পাচার বাড়ছে। তার মতে, পাচার রোধ করতে হলে দুর্নীতি কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। পাশাপাশি নাগরিক জীবনেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।
বাংলাদেশিদের আমানত : ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানতের স্থিতি ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ সুইস ফ্র্যাংক। আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে যা ছিল ১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্র্যাংক। ২০২২ সালে ছিল ৫ কোটি ৫৩ লাখ ফ্র্যাংক। তবে এর আগে ২০২১ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানতের স্থিতি ৮৭ কোটি ১১ লাখ ফ্র্যাংক। এটি এ যাবত কালের সর্বোচ্চ রেকর্ড। এছাড়াও ২০২০ সালে যা ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ডলার। ২০১৯ সালে ৬০ কোটি ৩০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৮ সালে ৬১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৭ সালে ছিল ৪৮ কোটি ১৩ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৬ সালে ৬৬ কোটি ১৯ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৫ সালে ৫৫ কোটি ০৮ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৪ সালে যা ছিল ৫০ কোটি ৬০ লাখ ফ্র্যাংক। স্বর্ণালংকার, শিল্পকর্ম এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র জমা রাখলে তার আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে আমানতে যোগ হয় না। তবে শুধু সুইস ব্যাংক নয়, অন্যান্য সংস্থা থেকেও টাকা পাচারের তথ্য আসছে।
আন্তর্জাতিক ৬টি সংস্থার রিপোর্টে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের তথ্য আসছে। এগুলো হলো-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিক্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (আইসিআইজে) প্রকাশিত পানামা প্যারাডাইস ও পেনডোরা পেপার্স, জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ইউএনডিপি) রিপোর্ট এবং মালয়েশিয়া প্রকাশিত সে দেশের সেকেন্ড হোম রিপোর্ট। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও সিঙ্গাপুরে বেশকিছু বাংলাদেশির অর্থ পাচারের তথ্য মিলেছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের আমানত : সুইস ব্যাংকে আমানত রাখার দিক থেকে এ বছর প্রথম অবস্থানে যুক্তরাজ্য। ২০২৪ সালে দেশটির আমানতের পরিমাণ ২৯ হাজার ৯৪৩ কোটি ফ্র্যাংক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৩ হাজার ১০৯ কোটি, সিঙ্গাপুর ৪ হাজার ৯৮২ কোটি, চীন ১ হাজার কোটি ফ্র্যাংক, রাশিয়া ১ হাজার ৯ কোটি, জাপান ১ হাজার ১৪৫ কোটি, তুরস্ক ৩৩৫ কোটি এবং মালয়েশিয়া ২৪১ কোটি ফ্র্যাংক। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আমানত আড়াইগুণ বেড়ে ৩৫০ কোটি, পাকিস্তানের আমানত ২৭ কোটি, নেপাল ৩৮ কোটি এবং বাকি দেশের আমানত লাখের ঘর ছাড়ায়নি।
আমানত কেন পাচার : সুইস ব্যাংক মূলত তাদের প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকা বিদেশিদের আমানতের তথ্য প্রকাশ করে। কিন্তু বাংলাদেশের আইনে কোনো নাগরিকের বিদেশি ব্যাংকে আমানত রাখার সুযোগ নেই। টাকা নিতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি লাগে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত কাউকে বিদেশে টাকা জমা রাখার বিশেষ অনুমোদনও দেওয়া হয়নি। এছাড়া কোনো প্রবাসীও সরকারকে জানাননি যে তিনি সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রেখেছেন। ফলে সূত্র বলছে, সুইস ব্যাংকে জমা হওয়া পুরো টাকা দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে।
টাকা পাচারের মাধ্যম : সাম্প্রতিক সময়ে দেশ থেকে টাকা পাচারের পরিমাণ বেড়েছে। মূলত কয়েকটি মাধ্যমে টাকা পাচার হয়। এরমধ্যে রয়েছে আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ভয়েসিং), হুন্ডি এবং ভিওআইপি ব্যবসা। এছাড়া বড় বড় ঘুস লেনদেন হয় দেশের বাইরে ডলারে, যা পাচারকৃত টাকারই অংশ। গত কয়েক বছরে সরাসরি বিদেশে লাগেজ ভর্তি করে ডলার নিয়ে যাওয়ার তথ্যও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
পাচারের অর্থ ফেরানোর উদ্যোগ : দেশের আর্থিক খাতের প্রকৃত অবস্থা মূল্যায়নে শ্বেতপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে গঠিত কমিটি ইতোমধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগের শাসনামলের ১৫ বছরে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই পরিমাণ টাকা গত ৫ বছরে দেওয়া দেশের জাতীয় বাজেটের চেয়েও বেশি। আলোচ্য সময়ে প্রতিবছর পাচার হয়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৫ বছরের পাচারের অর্থ দিয়েই ৭৮টি পদ্মা সেতু করা সম্ভব।
এদিকে প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে পাচারের অর্থ ফেরানোর কথা বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে পাচারকারীদের সম্পদ জব্দ করা শুরু হয়েছে।
মোট আমানত : প্রতিবেদন অনুসারে আলোচ্য সময়ে বিশ্বের সব দেশের আমানত কমেছে। আলোচ্য বছরে সুইজারল্যান্ডের ২৫৬টি ব্যাংকে আমানতের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৯৭ হাজার ৭১২ কোটি ফ্র্যাংক। আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে ছিল ৯৮ হাজার ৩৪৫ কোটি ফ্র্যাংক। এ হিসাবে এক বছরে আমানত কমেছে ১ হাজার কোটি ফ্র্যাংক।
সুইস ব্যাংক : সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) হলো সুইজারল্যান্ড সরকারের স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশটির রাজধানী বার্ন শহরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি বিশেষ আইন দ্বারা পরিচালিত। এর নীতিনির্ধারণ সবই স্বাধীন। ২০০ বছরের পুরোনো ইউরোপের এ প্রতিষ্ঠানটি মুদ্রা পাচারকারীদের নিরাপদ স্বর্গ। ব্যাংকটির মুদ্রানীতি এবং সুশৃঙ্খল কার্যক্রম বিশ্বের উন্নত দেশগুলো অনুসরণ করে। তবে পাচারকারীদের আশ্রয়দাতা হিসাবে আন্তর্জাতিক মহলে দেশটির বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০০২ সাল থেকে দেশভিত্তিক আমানতের তথ্য প্রচার শুরু করেছে ব্যাংকটি। কিন্তু আমানতকারীদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করছে না। তবে যেসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি রয়েছে, সেসব দেশের ব্যক্তিগত পর্যায়ে তথ্য দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, তারা কয়েক দফায় সুইস ব্যাংকে চিঠি দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া মেলেনি। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে এখন পর্যন্ত সুইস ব্যাংকের কোনো সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়নি।